আধুনিক সভ্য জগতে খনিজ তেল একটি প্রয়োজনীয় সামগ্রী। শক্তি, আলো, তাপ উৎপাদনের জন্য তেল প্রয়োজনীয়। খনিজ তেল পরিশোধিত করে গ্যাসোলিন, ডিজেল গ্যাস, কেরোসিন, পিচ্ছিলকারক তেল (Lubricant), প্যারাফিন প্রভৃতি পাওয়া যায়। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি চালাতে পেট্রোল ও ডিজেল ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশের তেলক্ষেত্রগুলো হতে তেল পর্যাপ্ত পরিমাণে উত্তোলিত হলে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব। এছাড়া এককভাবে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা যাবে । শিল্পকারখানায় কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়। ফেঞ্চুগঞ্জের সার কারখানায় ও ছাতকের সিমেন্ট কারখানায় হরিপুরের প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়। ঘোড়াশালের সার কারখানায় তিতাস গ্যাস কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কীটনাশক, ঔষধ, রাবার, প্লাস্টিক, কৃত্রিম তন্তু প্রভৃতি তৈরির জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়। চা বাগানগুলো রশিদপুরের প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ফার্নেস তেলের পরিবর্তে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার হয়। যেমন— সিদ্ধিরগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয় ।
কাজ : এককভাবে নিচের ছকটি পূরণ কর।
শিল্প | ব্যবহৃত গ্যাসক্ষেত্রের নাম |
ফেঞ্চুগঞ্জের সার কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসক্ষেত্রের নাম ছাতকের সিমেন্ট কারখানায় ঘোড়াশালের সার কারখানায় সিদ্ধিরগঞ্জের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আশুগঞ্জের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে |
কয়লা জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ও লাকড়ির পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া থেকে উত্তোলিত কয়লার ৬৫ শতাংশ বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। অবশিষ্ট ৩৫ শতাংশ কয়লা ব্যবহৃত হচ্ছে ইটভাটা ও কলকারখানাসহ অন্যান্য খাতে। বনজ সম্পদ রক্ষায় কয়লা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সরাসরি কাঠ বা লাকড়ি পোড়ালে পরিবেশের যে দূষণ হয় কয়লা ব্যবহার করলে সেই দূষণ হয় না। বনজ সম্পদ রক্ষা ও দূষণ রোধে কয়লা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করে।
কৃষির উন্নতি, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় হ্রাস, সরকারি আয়ের উৎস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই খনিজ দ্রব্যগুলো যথেষ্ট অবদান রাখে। এগুলো ব্যবহারের প্রতি আমাদের সচেতন ও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। আমরা এই মূল্যবান সম্পদগুলোর অপচয় করব না।
বাংলাদেশের প্রধান শিল্প (Main industry of Bangladesh )
কোনো দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত হচ্ছে শিল্পায়ন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে শিল্পখাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ অনুযায়ী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে জি.ডি.পি তে শিল্পখাতের অবদান হলো শতকরা ৩৫.১৪ ভাগ। বাংলাদেশের প্রধান শিল্পগুলো হলো—
পাট শিল্প (Jute industry) : বাংলাদেশে কৃষিনির্ভর শিল্পগুলোর মধ্যে পাট শিল্প অন্যতম। এ দেশের পর্যাপ্ত ও উৎকৃষ্ট পাট চাষ হওয়ায় কাঁচামালের সহজলভ্যতা পাট শিল্পের উন্নতিতে সহায়তা করছে। এ দেশে পাটের দক্ষ ও সুলভ শ্রমিক রয়েছে। সর্বোপরি পাট শিল্পের প্রতি সরকারের সাহায্য ও সহযোগিতা রয়েছে।
বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে অনেক পাটকল গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি মোট পাটকলের সংখ্যা ২০৫টি (চিত্র ১১.৫)। গড় বার্ষিক উৎপাদন ৬,৬৩,০০০ মেট্রিক টন। আমরা সহজে পাট শিল্পকে নিম্নোক্তভাবে দেখতে পারি।
পাট শিল্প কেন্দ্র অঞ্চল | পাট শিল্পজাত দ্রব্য | রপ্তানির দেশসমূহ |
নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, ডেমরা, ঘোড়াশাল, নরসিংদী, ভৈরববাজার, গৌরীপুর, মাদারিপুর, চাঁদপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও হবিগঞ্জ । | চট, বস্তা, কার্পেট, দড়ি, ব্যাগ, স্যান্ডেল, ম্যাট, পুতুল, শোপিস ও জুটন । | আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, মিসর, রাশিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ইতালি, জার্মানি, জাপান ও ফ্রান্স । |
বস্ত্র শিল্প (Cotton Textile Industry )
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, মিসর, রাশিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ইতালি, জার্মানি, জাপান ও ফ্রান্স ।
কার্পাস বয়নশিল্প বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। মানুষের খাদ্যের পরই বস্ত্রের প্রয়োজন হয় । তাই বস্ত্র শিল্পের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এ দেশের আবহাওয়া বস্ত্র শিল্পের অনুকূল। আলোচনার সুবিধার্থে বাংলাদেশের কার্পাস বয়নশিল্পকে কতিপয় অঞ্চলে বিভক্ত করা হয় (চিত্র ১১.৫)। যেমন—
ঢাকা অঞ্চল | চট্টগ্রাম অঞ্চল | কুমিল্লা ও নোয়াখালি অঞ্চল | রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চল |
ঢাকার মিরেরবাগ, পোস্তগোলা, শ্যামপুর, ডেমরা, সাভার; নারায়ণগঞ্জ জেলার নারায়ণগঞ্জ, মুড়াপাড়া, কাঁচপুর, ধমগড়, লক্ষণখোলা, ফতুল্লা, গাজীপুর জেলার টঙ্গী, জয়দেবপুর, কালিগঞ্জ; নরসিংদী জেলার নরসিংদী, মাধবদী, বাবুরহাট ও ঘোড়াশাল । | ফৌজদারহাট, | উত্তর কাউলি, ষোলশহর, পাঁচলাইশ, জুবলী আরিগোলা, রোড, , হালিশহর ও কালুরঘাট। | কুমিল্লার দূর্গাপুর, দৌলতপুর, হালিমানগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বাঞ্ছারামপুর ; নোয়াখালী অঞ্চলের ফেনী ও রায়পুর । |
রাজশাহী বিভাগে রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা; রংপুর বিভাগে দিনাজপুর এবং খুলনা বিভাগে কুষ্টিয়া, মাগুরা ও যশোর জেলার নোয়াপাড়া । |
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত তুলা ও সুতা দিয়ে বাংলাদেশের সুতা ও বস্ত্রকলগুলো পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ প্রতি বছর জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং, কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ তুলা, সুতিবস্ত্র ও সুতা আমদানি করে।
কাগজ শিল্প (Paper Industries)
কাগজ শিল্প বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহৎ শিল্প। ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশের চন্দ্রঘোনায় প্রথম কাগজের কল স্থাপিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারিভাবে ৬টি কাগজকল, ৪টি বোর্ড মিলস ও ১টি নিউজপ্রিন্ট কারখানা আছে (চিত্র ১১.৫)।
কাগজকলসমূহ | উৎপাদনের কাঁচামাল | উৎপন্ন কাগজ |
বাংলাদেশ হার্ডবোর্ডচন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী কাগজকল, পাবনায় পাকশীর উত্তরবঙ্গ কাগজকল, ছাতকের সিলেট মণ্ড ও মাগুড়া ও শাহজালাল কাগজকল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট কারখানা মিলস, আদমজী পার্টিক্যাল বোর্ড মিলস, কাপ্তাই ও টঙ্গী বোর্ড মিলস । | বাঁশ, নরম কাঠ, নলখাগড়া, আখের ছোবড়া, পাটকাঠি ও কাঁচা পাট। | লেখার কাগজ, ছাপার কাগজ, প্যাকিং ও অন্যান্য কাগজ এবং নিউজপ্রিন্ট। |
সার শিল্প (Fertilizer Industry)
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত ফসল। আর এজন্য প্রয়োজন সার। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে প্রথম সার কারখানা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে স্থাপিত হয়। বর্তমানে ১৭টি সার কারখানা থেকে সার উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান সার কারখানাগুলো হলো- ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ সার কারখানা, পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা, চট্টগ্রাম ট্রিপল সুপার ফসফেট সার কারখানা, চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা, জামালপুর জেলার তারাকান্দিতে যমুনা সার কারখানা ও ফেঞ্চুগঞ্জ অ্যামোনিয়াম সালফেট সার কারখানা (চিত্র ১১.৫)।
বাংলাদেশে বৃহৎ শিল্পের মধ্যে সার অন্যতম। প্রাকৃতিক গ্যাসের সহজলভ্যতার জন্য সার শিল্পের উন্নয়নের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সার রপ্তানি করতে বাংলাদেশ সক্ষম হবে।